গুজরাটের এক ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ! মধেরার সূর্য মন্দির!
ভারতের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত গুজরাট রাজ্য ভারতের “পশ্চিমের মণি”। ভারতের এক সবচেয়ে শিল্পোন্নত এবং সমৃদ্ধ রাজ্য গুজরাত আধুনিক প্রতিবেশ এবং যুগবাহিত ঐতিহ্যের একটি আনন্দময় সংমিশ্রণ।
গুজরাটের মানুষের মধ্য দিয়ে এই রাজ্যের স্পন্দনশীল সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটে।
গুজরাট দেশের এক অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটক গন্তব্য। এই রাজ্য তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক তাৎপর্য, হস্তশিল্প এবং অগণিত পর্যটক আকর্ষণের জন্য সুখ্যাত। ভারতের সবচেয়ে শিল্পোন্নত অঞ্চল হওয়া ছাড়াও গুজরাট সমগ্র দেশের একটি প্রধান কেন্দ্র। প্রেম, সহজাত দক্ষতা, রহস্য, স্পন্দনশীল রঙ এবং অসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি দেশ গুজরাট অসংখ্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
চলুন আজ আমরা মধেরার সূর্য মন্দির ঘুরে আসি।
#আহমেদাবাদ
মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে যুক্ত অপরিমেয় ঐতিহাসিক তাৎপর্যের কারণে আহমেদাবাদ গুজরাটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে এক অন্যতম। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকদের দ্বারা পরিদর্শিত গুজরাটের এই বিখ্যাত পর্যটক গন্তব্য তার অনন্য স্থাপত্যের জন্য জনপ্রিয়।
আহমেদাবাদের কিছু জনপ্রিয় পরিদর্শনীয় স্থানগুলি হল –
সবরমতি আশ্রম / মহাত্মা গান্ধীর ঘর
ক্যালিকো মিউজিয়াম অফ টেক্সটাইল
আদালাজ স্টেপ-ওয়েল
হাথি সিং জৈন মন্দির
কঙ্করিয়া লেক, ভাদ্র ফোর্ট
শেকিং মিনার
গান্ধিনগর
আহমেদাবাদের উত্তরে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত গুজরাটের রাজধানী গান্ধিনগর অক্ষরধাম এবং শামলাজি-র মত অসংখ্য পর্যটনকেন্দ্র!
আহমেদাবাদ থেকে পাটন হাইওয়ে হয়ে মধেরা (প্রায় ৯৭ কিমি)
#সূর্য_মন্দির
সূর্যের উদ্দেশ্যে নির্মিত একটি মন্দির। এটি আহমেদাবাদ থেকে প্রায় ৯৭ কি মি দূরে পুষ্পবতী নদীর তীরে মধেরাতে নির্মিত। মধেরা মহেশানা জেলার একটি ছোট শহর ।
মেহসানা একটি জেলা শহর ও পৌরসভা। চৌদ্দ শতকে প্রতিষ্ঠিত,মেহসানা চাওডা/চাভডা রাজবংশের উত্তরাধিকারী রাজপুত মেহসাজী চাভডা প্রতিষ্ঠা করেন!
চৌলুক্য বা সোলাঙ্কি রাজবংশের প্রথম ভীমের রাজত্বকালে 1026-27 খ্রিস্টাব্দে, মধেরার এই সূর্য মন্দিরটি নির্মিত হয়। বর্তমানে মন্দিরটি উপাসনার কাজে ব্যবহৃত হয় না। এটি ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে। সম্পূর্ণ মন্দিরের বিভিন্ন নকশা,কারুকাজ ও স্থ্যাপত্যের মাঝে বিভিন্ন গানিতিক সংখ্যা,জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের তাৎপর্যপূর্ণ সৌন্দর্য রয়েছে।
ব্রহ্ম পুরান মতে শ্রী রামচন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের পর ঋষি বশিষ্ঠের নিকট ব্রাহ্মণ (রাবণ) হত্যার জন্য নিজেকে শুদ্ধ করতে তীর্থ যাত্রা করতে চান। ঋষি বশিষ্ঠ তাকে ধর্মারন্যে গিয়ে যোগ সাধনা করতে বলেন। এই ধর্মারন্য বর্তমানের মধেরা বলে ধারনা করা হয়। শ্রী রামচন্দ্র এখানে সীতা পুর নামে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন।
এই মধেরাতে ১০২৬ সালে সোলাঙ্কি রাজা ভীমদেব। সূর্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন যখন গজনির সুলতান মাহমুদ গজনী সোমনাথ মন্দির ও এর আশে পাশের এলাকা ধ্বংস এবং লুট করছে। প্রায় 20,000 সৈন্যের একটি বাহিনী মোধেরায় আক্রমণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ইতিহাসবিদ এ কে মজুমদার তত্ত্ব জানায় যে সূর্য মন্দিরটি এই প্রতিরক্ষা স্মরণার্থে নির্মিত হয়েছিল।
এই মন্দিরটি প্রথম ধ্বংস করার চেষ্টা করে আলাউদ্দিন খিলজি।মন্দির ধ্বংসের আগে এখানে গণেশ, শীতলা, বিষ্ণু, কালীর ও নটরাজের মন্দির ছিল। মোট মন্দিরের সংখ্যা ছিল ১০৮টি। সেগুলো আলাউদ্দিন খলজি ধ্বংস করেন।
যদিও ধ্বংস ও ক্ষতি সাধনের পরও যা অবশিষ্ট রয়েছে মন্দিরের বিশেষত্ব ও তাৎপর্য বোঝানর জন্য সেটুকুই যথেষ্ট। মন্দিরটি এমন ডিজাইনে তৈরি যা সে সময়ে ভারতবর্ষের জ্যোতিষশাস্ত্র, সংখ্যাতত্ত্ব, ইত্যাদির জ্ঞান কোন পর্যায় ছিল- মন্দিরের স্থাপত্যকলা থেকে তা বোঝা যায়। সূর্য যখন বিষুবীয় সময়ে পৌছায় তখন সূর্যের প্রথম রশ্মি মন্দিরে স্থাপিত একটি সূর্যের ছবির উপর পড়ত।
মন্দিরের ছিল তিনটি প্রধান অংশঃ সূর্য কুণ্ড,সভা মণ্ডপ ও গুরা মণ্ডপ।
#সূর্যকুণ্ড রামকুণ্ড নামেও পরিচিত। এটি বেশ বড় আর আয়তাকার আকৃতির!
এখানে পবিত্র জল রাখা হত যেখানে ভক্তরা সূর্যদেব কে পূজার আগে অবগাহন করত। সূর্য মণ্ডপ তৎকালীন ভারতীয়দের জ্যামিতিক আর গানিতিক উৎকর্ষতার এক অনন্য নিদর্শন।এর চারিপাশ এর কম্পোজিশন করা ড্যাজলিং প্যাটার্নে । এটি অসংখ্য পাথরের তৈরি সিঁড়ি তে বিন্যস্ত যাতে খুব সহজে ভক্তরা নিচে নামতে পারত। এই সিঁড়ি গাত্রে ১০৮ টি কুঠি তৈরি আছে।
#সভা_মণ্ডপ
এটি তৈরি হয়েছিল ভক্তদের সমাবেশের জন্য।এটি সব দিক দিয়ে খোলা।এই মণ্ডপটি ৫২ টি অতি জটিল ও দুর্বোধ্য কারুকাজময় নকশা খোদাইকৃত খিলান দিয়ে ভিত দেয়া।এখানে ৫২ টি খিলান ব্যবহারের করা হয়েছে সৌর বছরের ৫২ টি সপ্তাহ বোঝানর জন্য।খিলান গুলোতে বিভিন্ন নকশার পাশাপাশি রামায়ণ, মহাভারত ও শ্রীকৃষ্ণ লীলা থেকে বিভিন্ন কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
#প্রধান_মন্দির
মন্দিরটি সম্পূর্ণ একটি উল্টো পদ্ম ফুলের স্তম্ভমুলের চতুষ্কোণ পীঠিকাবিশেষের উপর স্থাপিত।এটি এমন ভাবে ডিজাইন করা যেন প্রতি ২১ জুন সূর্য যখন উদিত হবে এবং অস্ত যাবে তখন আলোক রশ্মি রথে পরিভ্রমণ রত সূর্যদেবের উপর পড়বে!
সম্পূর্ণ ভাস্কর্যটি ছিল অতি মুল্যবান রত্নখচিত।সূর্যের রথটি ৭ টি ঘোড়া সম্বলিত (যা সপ্তাহের সাত দিনকে নির্দেশ করে)এবং সারথি অরুন চতুর্থ ঘোড়ায় উপবিষ্ট।সম্পূর্ণ ভাস্কর্যটি একদম খাটি সোনার তৈরি ছিল। স্বর্ণ ভাস্কর্যটি একটি কূপ বা গহ্বরের উপর স্থাপিত যা ১৫ ফুট গভীর ছিল। সম্পূর্ণ গহ্বরটি স্বর্ণ মুদ্রায় পূর্ণ ছিল যা সোলাঙ্কি রাজারা তাদের বংশানুক্রমিক পুজ্য দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করেছিলেন।
দুঃখের বিষয় এ গুলো মাহমুদ গজনী লুট করে এবং সম্পূর্ণ স্বর্ণমুদ্রা সহ ভাস্কর্যটি নিয়ে যায়।
মন্দিরের বাইরের দেয়ালে সূর্যের ১২টি ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গি দেখান আছে আর তার সাথে আছে ৮ টি দিক বা ৮জন দিকপাল। আরও আছে বিশ্বকর্মা যিনি ভগবান শ্রী কৃষ্ণের স্বর্ণের দ্বারকা নগরী তৈরি করে দেন,সিদ্ধিদাতা গনেশ,শিক্ষা ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতী মাতা। এছাড়াও আছে সমুদ্রমন্থনের দৃশ্য।
তৎকালীন সময়ের মধেরার শিল্প,সাহিত্য,কলা,জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতাকে স্মরণ করার জন্য প্রতি বছর উত্তরায়ণের সময়ে জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে
মন্দিরের পিছনে তিন দিন ব্যাপী উত্তরায়ণ উৎসবে ভারতের বিখ্যাত শিল্পীরা এখানে পারফর্ম করে দর্শকের মুগ্ধ করেন। উৎসবটি গুজরাট পর্যটন কর্পোরেশন আয়োজন করে।